কিভাবে আমরা লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করবো
লাউ হলো একটি শীতকালীন সবজি। এছাড়াও এটি গ্রীষ্মকালীনেও উৎপাদন করা হয়।বেশিরভাগই শীতকালে লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। আমরা বিভিন্ন উপায়ে লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করতে পারবো।
এটি যখন কাঁচা অবস্থায় থাকে তখন সবজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর যখন এটি পেঁকে যায় তখন বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন বোতল হিসেবে পাত্র বা নল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এজন্য লাউকে Bottle gourd বলা হয়। এই লাউ চাষ কিভাবে করে, এর পরিচর্যা, কিভাবে লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি সবকিছু নিয়ে আজকে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো। কখন কোন সার দিতে হবে,কোন কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে তা আমরা বিস্তারিত জানতে পারবো।
লাউ গাছের পরিচর্যা:
লাউ চাষাবাদ করার জন্য শুধু ভালো মাটি বা ভালো চারা নির্বাচন করা যথেষ্ট নয়। বেশি বেশি লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করার জন্য বেশি বেশি এর পরিচর্যা করতে হয়। যখন এটি বড় হয় তখন এর গোড়ার দিকে অনেক শাখা-প্রশাখা বের হয়। তা লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধির জন্য কেটে ফেলা উচিত। অর্থাৎ এটি যখন ২-৩ মিটার লম্বা হয় তখন এর গোড়ার দিকের শাখা-প্রশাখা কেটে ফেলতে হবে। যখন এর লতা আরেকটু বড় হবে তখন এর মাথা কেটে ফেলতে হবে।
আবার গাছে যখন ফুল আসবে তখন এর পরাগায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। যা সাধারণত হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন করতে হবে। তাহলেই লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি সম্ভব হবে। এছাড়াও লাউ গাছের আশেপাশের জায়গাতে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে, তাহলে এর ফলন বৃদ্ধি সম্ভব।
লাউ গাছের জন্য কীটনাশক ব্যবহার:
লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করার জন্য ১০ দিন পরপর এর উপর কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত এর ব্যবহার পোকামাকড় দমনে করা হয়ে থাকে। যেমন বিভিন্ন ধরনের জাব পোকা, গান্ধী পোকা, বিটন পোকা, মাছি ইত্যাদি পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
এইসব পোকাগুলো চারা এবং বড় উভয় অবস্থায় আক্রমণ করে থাকে। এছাড়াও চারা গাছ থাকা অবস্থায় এটি সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলে। এইসব পোকামাকড়ের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য ম্যানকোজেব এবং কার্বনডাজিম জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। সাধারণত সাত দিন পর পর এক লিটার জলে ২ গ্রাম কীটনাশক মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে পুরো গাছে।
এছাড়াও লাউ গাছের আশেপাশের সুরঙ্গকারি পোকা দমনের জন্য সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। যার ফলে আমরা লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করতে পারব।
লাউ গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি:
লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করার জন্য আমাদের এতে সার প্রয়োগ করতে হবে। লাউ চাষের জন্য উর্বর জমি যথেষ্ট নয় এতে সার মেশাতে হবে, তাহলে এটি চাষের জন্য উপযুক্ত হবে। লাউ চাষের সময় জমিতে প্রতি হেক্টরে ৫০-৬০ টন গোবর সার মিশিয়ে জমিতে ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়াও লাউ চাষে জমির জন্য ফসফরাস এবং নাইট্রোজেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা সাধারণত ৫০ কেজি নাইট্রোজেন এবং ৬০ কেজি ফসফরাস হলেই হয়ে যায়। এছাড়াও লাউ চাষের জমির জন্য হেক্টর প্রতি ৪-৬ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়ে থাকে। এছাড়াও মাছ ধরা জল সবজির খোসা এইসব দিয়ে লাউ চাষের জন্য খুবই ভাল সার তৈরি সম্ভব হয়।
আবার চা খাওয়ার পর যে চা পাতা থাকে সেগুলো দিয়ে,পচা দুধ,টক দই এসব দিয়ে ভালো সার তৈরি হয়। এইসব সার অবশ্যই আমাদেরকে ছেঁকে ব্যবহার করতে হবে এবং এতে পানি মিশিয়ে তার ঘনত্ব কমিয়ে দিতে হবে। তাহলেই লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি সম্ভব হবে।
লাউ গাছের রোগ ও প্রতিকার:
লাউ গাছের বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে। এসব রোগ গুলোকে আমরা যদি এর প্রতিকার করতে পারি তাহলে লাউ গাছের বেশি বেশি ফলন বৃদ্ধি পাবে। লাউ গাছের কয়েকটি রোগ তুলে ধরা হলো-
- লাউ গাছের পাতা পোড়া রোগ
- লাউ গাছের গোড়া পঁচা রোগ
- লাউ গাছের লিফ কার্ল রোগ
- লাউ গাছ নেতিয়ে পড়া রোগ
- লাউ গাছের পাতার পাউডারী মিলিডিউ রোগ
- লাউ গাছের পাতা কোকড়ানো রোগ
- লাউ গাছের আঠাঝরা রোগ
এইসব রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে প্রথমে গাছের আক্রান্ত অংশটুকু ছাঁটাই করে ফেলতে হবে। এছাড়াও লাউ চাষের আগে আমাদেরকে বীজ শোধন করা লাগবে এবং চারা জন্মানোর পর বেশি বেশি সেচ দেওয়া যাবে না। আর যদি গাছ ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত হয় তাহলে প্রতি হেক্টরে ২ কেজি করে ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করতে হবে।
তাহলে আমরা এর নেতিয়ে পড়া রোগ এবং পাতা কোকড়ানো রোগ থেকে মুক্তি পাবো। আবার এতে আগাছা এবং ময়লা থাকলে তার পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক নাশক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও ভাইরাসজনিত আক্রান্ত গাছ বাছাই করে তা নষ্ট করে দিতে হবে এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন উন্নত জাতের লাউ গাছ উৎপাদন করতে হবে। তাহলে আমরা বেশি বেশি লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবো।
গ্রীষ্মকালীন লাউ চাষ:
বর্তমানে গ্রীষ্মকালেও লাউ চাষ করে এর বেশী বেশী ফলন বৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছে। কৃষকরা গ্রীষ্মকালে লাউ চাষ করে অধিক লাভবান হচ্ছে। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকার কৃষকরা গ্রীষ্মকালে লাউ চাষ করে অনেক লাভবান হচ্ছে। কেননা গ্রীষ্মকালে পাহাড়ি এলাকায় লাউ চাষের জন্য বেশ উপযোগী আবহাওয়া রয়েছে এবং এর জমির উর্বরতার জন্য বেশি বেশি লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাহাড়ি অঞ্চল গুলো হলো-খৈয়িছড়া, হিঙ্গুলী, দুর্গাপুর, মঘাদিয়া, সাহেরখালী ইউনিয়ন উপজেলা গুলোতে বেশি বেশি লাউয়ের ফলন বৃদ্ধি হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে সাধারণত কৃষকরা চার ধরনের লাউ চাষ করে বেশি লাভবান হয়ে থাকে। যেমন গ্রীনলেডি লাউ, গ্রিনডায়মন্ড লাউ, ডায়না লাউ এবং বারী লাউ চাষ করে থাকে। গ্রীষ্মকালে লাউ চাষের জন্য প্রথমে বীজগুলোকে শোধন করে নিতে হবে। লাউ চাষের জন্য বিঘা প্রতি ৩০০-৬০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হবে। এছাড়াও জৈব পদার্থ মিশ্রিত দোআঁশ মাটি এবং এঁটেল দোআঁশ মাটি উত্তম।
এছাড়া গ্রীষ্মকালে ৫ থেকে ৭ দিন পর পর লাউ গাছে সেচ দিতে হবে। আবার লাউ গাছকে ভালো রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে এবং সার প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই আমরা গ্রীষ্মকালে লাউয়ের বেশি বেশি ফলন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবো।
শীতকালীন লাউ চাষ:
সাধারণত শীতকালীন সবজি হিসেবে লাউকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা এটি শীতকালে সবচেয়ে বেশি ফলন হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত বসত বাড়ির আশেপাশে লাউ গাছ লাগিয়ে এর ফলন বৃদ্ধি করে থাকে। যদি আমরা বেশি বেশি লাউ চাষ করতে চাই তাহলে ভালো উর্বর যুক্ত জমি নির্বাচন করতে হবে।
সাধারণত হেক্টর প্রতি ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে। তারপর যখন এটি চারা হবে তখন প্রতি মাদায় দুইটি করে গাছ রোপন করতে হবে। তারপর এটি যখন ১৫ সেন্টিমিটারের বড় হবে তখন এটি মাচায় তুলতে হবে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি লাউকে মোজাইক ভাইরাসে আক্রমণ করতে পারে। তার জন্য আমাদেরকে উপযুক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। সাধারণত কৃষকদের শীতকালে লাউ চাষের জন্য একটাই সমস্যা আর সেটি হলো তাপমাত্রা। যদি শীতকালে তাপমাত্রা অনেক কম হয় তাহলে এটি লাউ চাষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
এর ফলে কৃষকরা শীতকালে লাউ চাষ করে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার জন্য আমাদেরকে জমিতে বিভিন্ন ধরনের জৈব পদার্থ, নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস মিশ্রিত করতে হবে। যার ফলে শীতকালে তাপমাত্রা কম হলেও আমরা লাউ চাষ করতে পারবো এবং বেশি বেশি লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবো।
লেখকের শেষ মন্তব্য:
কিভাবে আমরা লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করবো তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা লাউ গাছের পরিচর্যা কিভাবে করবো, সার প্রয়োগ করা, কীটনাশক ব্যবহার অর্থাৎ লাউ গাছের সম্পূর্ণ চাষাবাদ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানতে পেরেছি। মূলত এই আর্টিকেল পড়ে আপনারা কিভাবে অধিক লাউ গাছের ফলন বৃদ্ধি করবেন তা জানতে পেরেছেন।
আশা করি আপনারা লাউ চাষের জন্য মূল বিষয়গুলো জানতে পেরেছেন। এতক্ষণ ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য আন্তরিকভাবে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি যদি এরকম আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে চান তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটে প্রতিনিয়ত নজর রাখুন।
আর্লিটেক বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url